ভুমিকা
বলতে দ্বিধা নেই, আমি এক বেকার যুবক। যেন সৃষ্টির এক ব্যর্থ অপচয় ৷ বাবা এক আধাসরকারি অফিসের পেনশনভোগী এক প্রাক্তন কেরানি। বাড়ির সক্ষম বড়ো ছেলে আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-দুটো ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা আমার করায়ত্ত।
ছাত্রজীবনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন
ছাত্রজীবনে আমাকে ঘিরে কত স্বপ্ন! মাধ্যমিকে নামের পাশে এক দাঁড়ি দেখায় বাড়িসুদ্ধ সবার কী গভীর প্রত্যাশা! সংসারে অনেক সখ-আহলাদকে কাটছাঁট করে সকাল-সন্ধ্যায় বাড়িতে দু-দুটো টিউটর। ফল বেরোলে দেখা গেল দু-দাঁড়ি। উচ্চমাধ্যমিকে বহু ধরাকরা করে বিজ্ঞান বিভাগে ছাড়পত্র মিলল এই প্রত্যাশায় যে, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের বেড়া টপকানোর শিকেটা ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে । তাহলে ঠেকায় কে? হয় ডাক্তার, না হয় ইঞ্জিনিয়ার। সত্যি, আশা কী কুহকিনী! ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন গেল উড়ে। উচ্চমাধ্যমিকের সাফল্য কোনো রকমে বজায় রইল দু-দাঁড়ির সার্টিফিকেট নিয়ে। আর ওরই জোরে মহাবিদ্যালয়ের প্রবেশের সৌভাগ্য এসে গেল। যথাসময়ে নামের পাশে সাড়ম্বরে ডিগ্রি বসানোর শংসাপত্রও দিল বিশ্ববিদ্যালয়। কত স্বপ্ন চাকরি হবে, সংসারের আর্থিক সাচ্ছল্য আসবে, ছোটো ভাই বোনেরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, সংসারের অর্থাগমের নিশ্চয়তা সুনিশ্চিত হবে।
চাকরির সন্ধানে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি
বাস্তব কত কঠোর! নিষ্ঠুর! নির্মম! কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখে কর্মপ্রার্থীর দিনের পর দিন অবিরাম সানুনয় আবেদন। কখনও নির্বাচনী পরীক্ষার ডাক পড়ে তো, কখনও পড়ে না। সর্বত্র ব্যর্থতা আর নৈরাশ্যের গ্লানি। কোথাও কোথাও ডোনেশনের নামে মোটা টাকার উৎকোচ প্রদানের নগ্ন প্রস্তাব। কোথাও বা পদপ্রাপ্তির প্রস্তাবকে নিলামে তুলে প্রার্থীদের কে কত দিতে সক্ষম তার প্রতিযোগিতা। বেকার যুবকের জীবনে এসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা ৷
ব্যর্থতা ও স্বপ্নভঙ্গ
আমার চাকরি নিয়ে হন্যে হয়ে এরকম দাপাদাপি চলছে, এরই মাঝে বাবার চাকরির প্রান্তে পড়ে সমাপ্তির ছেদরেখা। সংসারের অফুরান চাহিদার রাক্ষুসে ক্ষুধা বাবার প্রাপ্ত প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির টাকাগুলো কয়েক মাসেই উদরস্থ করে তফিলটাকে শূন্য করে ফেলে। বাবা যতদিন চাকরিতে ছিলেন ততদিন ছিল আয়ব্যয়ের সমান পাল্লা। কাজেই বাড়তি সঞ্চয়ের প্রশ্নই ছিল না। যদি থাকে, তা ছিল একটা মানুষকে ঘিরে, বুঝতেই পারছেন, মাসে মাসে তার পিছনে রেকারিং ডিপোজিটের মতো অর্থ ব্যয় করে পরিশেষ তার চাকরির মধ্যে দিয়ে সুদে-আসলে গচ্ছিত অর্থ তুলে নেওয়া। কথাটায় শ্লেষ থাকতে পারে, কিন্তু প্রত্যাশা নিরর্থক মা- বাবার বাকি জীবন, ভাই- বোনদের লেখাপড়া, সংসারের লোক-লৌকিকতা—কী হবে; নিঃশেষ হয়েও সামাজিক ঠাটটুকু বজায় রাখতে হচ্ছে বাইরের মানুষের কাছে। না পারছি কুলিগিরি করতে, না পারছি খেতে- খামারে কাজ করতে। আমার এতদিনের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে।
বেকারত্বের পরিণাম
যে জীবনটাকে স্কুল-কলেজের চৌহদ্দিতে রেখে এসেছি; সেখানে কত উপদেশ, কত আশার কথাই না শুনেছি। আশায় মানুষ বুক বাঁধে। উচ্চাশা মহত্ত্বের ভিত্তিভূমি। দিনের পর দিন প্রত্যাখ্যাত কর্মপ্রার্থী যুবকের কাছে এসব উপদেশ ও বাণী কি ব্যর্থ পরিহাস হয়ে দেখা যায় না ? কঠোর বাস্তবের রূঢ় আঘাতের মুখোমুখি হয়ে কয়টা যুবপ্রাণই বা মনের শুভবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে? ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, নিরুপায় অক্ষমতা আর সহস্র আঘাতের মর্মদাহই কি তাদের মানসিক বিকৃতির কারণ নয়? তার পরিণামে কিভাঙার নেশায়, ধ্বংশের উন্মাদনায়, চুরি-রাহাজানির মতো সমাজবিরোধী কাজে নিজেদের নষ্ট করে না ?
আর্থসামাজিক ব্যবস্থা
সব দায়দায়িত্বের কারণ হিসেবে কাউকে যদি আসামির কাঠগোড়ায় দাঁড় করাতে হয়, আমি মনে করি, সে আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। ধনতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর অন্যতম ফলশ্রুতি হল বেকারত্ব। সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অতি আধিপত্য বিস্তারের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিপুল মুনাফা অর্জন । অল্প মানবিক শক্তি-প্রয়োগে অধিক পণ্য উৎপাদন; তার সঙ্গে আছে যন্ত্রনির্ভরতা, যন্ত্রের অতি বেশি খবরদারি। কম্পিউটার রোবটের মতো যন্ত্রমানব ও অটোমেশনের প্রয়োগ বেকারের সংখ্যা দিয়েছে বাড়িয়ে।
উপসংহার
ছেলেবেলায় শুনতাম লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। কথাটা হয়তো সেকালে খাটত । এ যুগের কবি আমাদের মতো নিষ্ফল হতাশদের দেখে লেখেন, লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে। অন্ধকারময় ভবিষ্যতের আতঙ্কভরা দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে মাঝে শুনি অনাহারে মৃত্যুর পদধ্বনি।
আরও পড়ুনঃ