ভূমিকা
আমার স্কুল-জীবনের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে আজ একসঙ্গে কতো কথাই না মনে পড়ছে। ছোটো-বড়ো নানা ঘটনা, দুঃখ-সুখের নানা কাহিনি – সবই যেন মনের মধ্যে এক সঙ্গে ভিড় করছে। আমার স্কুল-জীবন শুরু হয় আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে এসে প্রথম ভর্তি হই। আজ আমি সেই একই স্কুলের দশম শ্রেণির শেষপ্রান্তে। অর্থাৎ আমার স্কুল-জীবনের পরিধি হলো মোট নয় বছর। এই ক’বছরে আমার শিক্ষার্থী-জীবন দোলায়িত হয়েছে নানা সুখে-দুঃখে, ভয়-সঙ্কোচে, আশায়-নিরাশায়। স্কুলে প্রবেশ করবার প্রথম দিনটির কথা আজও আমার স্মৃতিতে সুস্পষ্টভাবে উঁকি দিচ্ছে। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। একে অপরিচিত পরিবেশ, তার উপরে চেনা-জানা কাউকেই দেখছি না। তা ছাড়া, পাড়ার একটি ছেলের কাছে শুনেছিলাম, এই স্কুলের মাস্টারমশাইরা নাকি খুব কড়া, পড়া না পারলে কঠোর শাস্তি দেন। ফলে, স্কুলে ঢুকে কেমন যেন ভয়-ভয় করছিল, আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ক’দিন যেতে-না-যেতেই বুঝতে পারলাম, আমার ভয় নিতান্তই অমূলক। শিক্ষকমশাইরা ছাত্রদের নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে পড়া হ’লেও সহৃদয়। কোনো ছাত্র কোনো বিষয় ভালো বুঝতে না পারলে তা তাঁরা সহজ সরল ক’রে মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে দেন।
শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচয়
দিনকয়েক কেটে যাবার পর, আমার আড়ষ্টতা দূর হ’লো। ক্রমে শিক্ষক ও সতীর্থদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার স্কুল-জীবনও সহজ হয়ে এলো। লেখাপড়ায় আমার মনোযোগ ছিল ব’লে শিক্ষকদের দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয়েছিল আমার দিকে। অঙ্কের কোনো জটিলতা বুঝতে না পারলে, সোজা গিয়ে হাজির হয়েছি অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কাছে। তিনি সাগ্রহে আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। সহজ অঙ্ক ভুল করবার জন্য পঞ্চম শ্রেণিতে একবার গণিতশিক্ষক বিজয়বাবুর কাছে বকুনিও খেয়েছি। লজ্জায় মুখ লুকিয়েছি তখন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাংলা পড়াতেন হৃষিকেশবাবু। ভারি মজার মানুষ ছিলেন তিনি। বানান-ভুল ও উচ্চারণের ভুল নিয়ে তিনি ক্লাসের অনেক ছাত্রকে কম নাস্তানাবুদ করেননি। আমরা সকলেই খুব মজা পেতাম তাঁর সরস কথাবর্তায়।
স্মরণীয় মুহূর্ত
স্কুল-জীবনের আনন্দ-সুখের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীসভার স্মৃতি, মনে প’ড়ে যায় সরস্বতী পুজোর কথা, চোখের সামনে ভেসে ওঠে খেলাধুলা ও অভিনয়ের কথা। আমি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য যেমন পুরস্কার পেয়েছি, তেমনি কবিতা-আবৃত্তিতে বরাবর প্রথম পুরস্কার পেয়ে এসেছি। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে প্রত্যেক বছরই আমাদের স্কুলে আবৃত্তি ও নাটকাভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। আবৃত্তি করে আমি যেমন আনন্দ পেয়েছি, তেমনি মানসিক তৃপ্তি পেয়েছি দেশাত্মবোধক নানা নাটকে অভিনয় ক’রে। একবার ‘বীর-বন্দনা’নাটকে রানা প্রতাপের ভূমিকায় অভিনয় ক’রে সকলের কাছে প্রচুর প্রশংসা পাই। সেই পূর্বস্মৃতি আজও আমার মনে যেন সজীব হয়ে আছে।
স্কুল জীবনের দুঃখের স্মৃতি
তেমনি মনে পড়ে স্কুল-জীবনের সুগভীর দুঃখ ও শোকের ঘটনা। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সুবিনয় বলে আমাদের সঙ্গে একটি ছেলে পড়তো। ছেলেটির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও, মনে মনে আমি তার বিশেষ অনুরাগী ছিলাম। কারণ, শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় সুবিনয়ের কোনো জুড়ি ছিল না আমাদের ক্লাসে। ফুটবল খেলায় সে ছিল আমাদের স্কুল-টীমের সেরা খেলোয়াড়। সেই ছেলে হঠাৎ একদিন বিকেলে বাস-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালো। খবর পেয়েই আমরা ছুটলাম হাসপাতালে। শুনলাম যাত্রীভর্তি চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে ওর হাত ফসকে যায় হ্যাণ্ডেল থেকে। ও বাসের তলায় পড়ে যায় এবং বাসের পিছনদিককার চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। সহপাঠী সুবিনয়ের সেই আকস্মিক মৃত্যু যেন আমার মনে সহোদর ভ্রাতার মৃত্যুর মতোই সুগভীর শোকের ছায়া বিস্তার করে।
উপসংহার
স্কুল-জীবনের আরও কত স্মৃতিকথা আমার মড়ে পড়ছে। মনে পড়ছে, বাংলা শিক্ষক হৃষিকেশবাবুই আমাকে ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখায় প্রথম উৎসাহ দিয়েছেন। মনে পড়ছে স্কুল-ম্যাগাজিনে যেদিন আমার প্রথম কবিতা ছাপার হরফে প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিন অনাস্বাদিত গভীর আনন্দে আমি কেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। মনে পড়ছে, স্কুল থেকে একবার আমরা দলবেঁধে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, আর একবার গিয়েছিলাম ডায়মণ্ডহারাবারে। আমাদের সঙ্গে স্কুলের দু’তিনজন কর্মচারী এবং কয়েকজন শিক্ষকও ছিলেন প্রতিবারের ভ্রমণে। এ-কথা আজ স্কুল-জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বারবার অনুভব করছি যে, আমাদের স্কুলের সঙ্গে আমার যেন একটা অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসা ও মমতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
আরও দেখুনঃ