আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা

ভূমিকা

মন স্মৃতির এক প্রকাণ্ড জালা। তাতে ফুটো অনেক! অহরহ তা দিয়ে স্মৃতি ঢুকছে আর বেরিয়ে আসছে। মনের ভিতরে যা রয়ে যাচ্ছে তা কেবলই ঠোকরাচ্ছে। পেটের কথা ফাঁস না করলে নিস্তার নেই। কত দিন আগের কথা! তখন বয়স কত কম! তবু আজও সেদিনের দুর্যোগের রাত্রিটুকুর কথা ভুলতে পারিনি। স্মৃতি কেবলই খোঁচা দিচ্ছে।

সেদিনের কথা, ঝড়ের পূর্বাভাস

মনে আছে। মা’র আঁচল ধরে সেবার বেরিয়েছিলাম। গন্তব্য স্বরূপনগর, মাসির বাড়ি। সময়টা গ্রীষ্মের গোড়ার দিক। আদর আর আপ্যায়নের মধ্যে বেশ কটা দিন ওখানে কেটে গেল। চলে আসার দু’একদিন আগের কথা। মা আর মাসির সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, মাসির বন্ধুর বাড়িতে। বাড়ি অদূরেই, চাঁদপাড়ার ওখানে। ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গেল। ফেরার পথে টনক নড়ল। এক পোঁচ কালো রঙ যেন গোটা আকাশকে গিলতে আসছে। হাওয়া যেন বইতে ভুলে গেছে। সবকিছু অস্বাভাবিক চুপচাপ। এর মধ্যেই দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরতে হ’ল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ঘরে ঘরে মঙ্গল শাঁখের আওয়াজ যেন জোরেই শোনা গেল। সন্ধ্যা গাঢ় হওয়ার পরেই আকাশ ঝলসানো দৃশ্য। কড় কড়-কড়াৎ। প্রথম বাজটা পড়ল।

ঝড়ের শুরু

ভয়ে সবাই তটস্থ। গ্রামীণ জীবন। দু’একটা পাকা বাড়ি বাদে সবই তো মাটির। ঝড় যদি মারাত্মক হয় তো সেগুলো পড়তে কতক্ষণ! এরমধ্যে অজস্র কাজের খবরদারি শুরু হয়ে গেল। সবাই চায় শুধু বৃষ্টি হোক। তাহলে বিপদের ভয় থাকে না। ইতি মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল। সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত্রিটা তখন সবে ধরেছে। হঠাৎ প্রবল বেগে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। হাওয়ায় সোঁদা গন্ধ। তারপর দমকা হাওয়া। হাওয়ার প্রচণ্ড দাপটে উঠানের নারকেল গাছের মাথা নুয়ে পড়তে লাগল।

ঝড়ের তাণ্ডব

শুরু হলো ঝড়। প্রবলবিক্রমে পথের ধুলো ঘূর্ণিপাক হয়ে উড়তে লাগলো। পথে জমে থাকা শুকনো পাতা উড়ে উড়ে ঘরে ঘরে ঢুকতে লাগলো। হঠাৎ তীব্র শব্দ। ও পাশের গোলাটা ভেঙে পড়ে গেলো। ছুট, ছুট, ছুট। ধানগুলো বাঁচাতে হবে। অর্ধেক বাঁচলো। অর্ধেক কোথায় উড়ে চলে গেলো। ইয়াকুবদের চালাঘরও ভেঙে পড়েছে। আমাদের নারকেল গাছটাও পড়বে পড়বে করছে। ঠাকুর মশাইয়ের গোয়ালঘর বিপর্যস্ত। মোড়ের ধারের বিশাল পাকুড় গাছটা আছড়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে শোনা যায় বিকট শব্দ। হয়তো কোন ঘর পড়লো, হয়তো কারও চালা উড়লো, কিংবা কারও গাছ পড়লো । মাসিদের পাকাবাড়ি। তারও নিস্তার নেই। একটা জানলার পাল্লা সশব্দে আছড়ে পড়লো ঘরের মেঝেতে। চর্তুদিকে হাহাকার রব। গ্রাম আজ বিপর্যস্ত। আমি মায়ের কোলে চুপটি করে লুকিয়ে ঘুম- ভাঙানিয়া সোঁ সোঁ রব শুনছি।

ঝড়ের শেষ

রাত গড়িয়ে যখন প্রায় একটা বাজল তখন ঝড় শান্ত হলো। নামলো বৃষ্টি। চললো সারারাত। থামলো পরদিন ভোরে। শুরু হলো পাখিদের সম্মিলিত রব। সবার বাসা ভেঙেছে। বেলা গড়াতেই পথে বেরোলাম। পথঘাট সব তছনছ। পুকুরপাড়ের দুটো তালগাছ মটকেছে। আমবাগানও বিপর্যস্ত। মাটির বাড়িগুলোর কোনটার দোতলা হুড়মুড়িয়ে পড়েছে, কোনটা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, দেখে বোঝার জো নেই। তার উপর আবার বৃষ্টি পড়ছে।

উপসংহার

খবরের কাগজে চোখ মেললেই দেখা যায় অমুক জায়গায় ঝড়, তমুক জায়গায় বন্যা, আমরা শহরের মানুষ—গ্রামের ঝড়ের তাণ্ডব কিংবা বন্যার আক্রমণ কতটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে তা কল্পনাও করতে পারি না। সেই একবারই ছোটোবেলায় আমি ঝড়ের তাণ্ডবমূর্তি দেখেছি। সেই  রাত্রির কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে শিউরে উঠি।

আরও দেখুনঃ

একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা

একটি পাহাড় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা

পুরী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা

Leave a Comment