ভূমিকা
বাতাস কেমন অন্যরকম, আকাশ একটু বেশি নীল, ঝলমলে নয় ঝিলমিলে রোদ, গাছগুলো একটু গাঢ় সবুজ—এসবের মানে কী? মানে একটা আছে, তা হল ‘ছুটি’। আজ, মহালয়ার ছুটি।
ঘুম ভাঙলো
ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস ভোর পাঁচটায়। রবিবারে অবশ্য ছটা সাড়ে ছটার আগে উঠি না। কিন্তু আজ উঠেছি চারটের সময়। কারন আজ যে মহালয়া। রেডিওতে মহালয়া শুনতে হবে না! বাবা অবশ্য বলেন অনুষ্ঠানটার নাম ‘মহিষাসুর মর্দিনী’, কিন্তু সবাই বলে মহালয়া। দাদু বলেছে মহালয়া একটা তিথি। সে যাই হোক, ওটা না শুনতে পেলে পুজোর অর্ধেক আনন্দই মাটি। মহালয়া শোনার পর থেকেই ঠিক পুজো-পুজো ভাবটা এসে যায়। এখন চুপ করে পড়ে থেকে শুনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘যা দেবী সর্বভূতেষু …। শেষ হলে উঠে মুখ ধুতে হবে। তারপর চায়ে চুমুক।
খাওয়া-দাওয়া
একমাত্র ছুটির দিনেই বাবা মন দিয়ে বাজার করেন। এই ব্যতিক্রমী দিনগুলোর মধ্যে রবিবার পড়ে না। কারণ রবিবার ছুটি থাকলেও টিভি-তে হরেক ধারাবাহিক থাকে। ফলে সময় ও মন দুটোই ওদিকে দিতে হয়। ছুটির দিনে বাবার বাজারে মন দেওয়া মানে মায়ের সামনে ভালো-মন্দ রান্নার সুযোগ। কখনো কখনো বাবা সাহায্যও করেন, এমনকী আমিও। রবিবারও এগুলো ঘটতে পারত, কিন্তু ওই টিভি। অন্য দিন বাবা বেরিয়ে যান সাড়ে আটটায়, আমার স্কুল দশটায়। ফলে একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ভালো-মন্দ খাওয়া হয়ে ওঠে না। রবিবার হয় বটে, তবে এরকম ছুটির দিনের মজাটাই আলাদা। আজ বাবা অনেকক্ষণ ধরে বাজার করেছেন। মা রান্না করেছেন ভাজা বড়ি ছড়ানো শুক্তো, নারকেল দিয়ে মুগ ডাল, বেগুনভাজা, মাছের ডিমের বড়া আর ইলিশ মাছের পাতুরি। আমি আর বাবা দুজনে মাকে সাহায্য করেছি, মানে কাজ বাড়িয়েছি। সবার স্নানের পর একসঙ্গে খেতে বসা। বাবা আমাদের দেশের বাড়ির দুর্গাপুজোর গল্প জুড়লেন।
বইপড়া
এই রকম ছুটির দুপুর হয় বই পড়ে, না হয় গান শুনে কাটানোই আমার সবথেকে পছন্দ। রবিবারে টিভি-তে এই সময় পুরস্কারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক ভাষার ছবি থাকে। সেটা আমি দেখি। ইদানীং অবশ্য প্রায়ই বাজে ছবি দেখায়। কাগজওয়ালা আজ দুটো পুজোসংখ্যা পত্রিকা দিয়ে গেছে। এগুলো পড়া শেষ হতে অনেকদিন লেগে যায়। বিশেষত আমার। স্কুলের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পড়তে হয়। কিন্তু নতুন পুজোসংখ্যার পাতা ওলটানোতেই কি কম আনন্দ। একটি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত সুন্দর সব ছবি আর চিত্র। এখন একটু গান শোনা যেতে পারে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বা চণ্ডীদাস মালের আগমনী কিংবা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত।
সান্ধ্য ভ্রমণ
সান্ধ্য ভ্রমণ শব্দটার মধ্যে একটু অভ্যাস বা দৈনন্দিনতার আভাস থাকলেও সেই নিয়মতান্ত্রিকতা আমাদের স্পর্শ করছে না। কারণ বাবার অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়, আমি জিমন্যাশিয়ান থেকে ফিরি সন্ধ্যেবেলা, মা ওই সময় একটু গান-টান শোনে। ফলে আমাদের আজকের সান্ধ্য ভ্রমণ দৈনন্দিনতা থেকে মুক্ত। আসলে এই মহালয়ার দিনই মা পুজোর বাজার শেষ করতে ভালোবাসেন। সূর্য পশ্চিমে ভাঙা মেঘের আড়াল হলে রঙিন আলো মেখে আমরা চললাম গড়িয়াহাটের দিকে। হকার্স কর্নারের অপূর্ব কোরাসের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে কেনা হল হরেক জিনিস। আমি একটা জিনসের প্যান্ট কিনলাম, আমার জমানো টাকায়।
নৈশভোজ
কেনাকাটা সারা হতে বাবা কোনো রেস্তোরাঁয় নৈশভোজ সারার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু সমস্যা, কী খাওয়া হবে? মা বললেন ‘চাইনিজ’, বাবা বললেন, না ‘সাউথ ইন্ডিয়ান’। আমার কাস্টিং ভোটটা ‘চাইনিজ’-এর পক্ষে গেল। ম্যান্ডারিনে বসে পর্ক চাউমিন, বোনলেস চিলিচিকেন ও আইসক্রিম নিয়ে মেতে গেলাম। বোনলেস চিকেন আমার ভীষণ প্রিয়। এতক্ষণে ছুটিটা যেন সম্পূর্ণতা পেল। বাবা সম্বার বড়া, মশালা দোসা আর লস্যির গুণকীর্তন করার চেষ্টা করেও পারলেন না। চাউমিন ওঁকে ব্যস্ত রেখেছিল। কেন যেন বাবা ঠিক চাউমিন ম্যানেজ করতে পারে না। তাই এত অনীহা। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
উপসংহার
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে ডায়েরি লিখলাম। কাল আবার একটা নতুন দিন। কারণ, পাঁজিতে তো দিনের শেষ লেখে না’। ভাগ্যিস লেখে না। একটা ছুটির দিন কেটে গেলে আরেকটা ছুটির দিনের সম্ভাবনা এগিয়ে আসে। মাঝে কিছু কর্মব্যস্ত দিন। যার জন্যেই ছুটি মূল্যবান হয়ে ওঠে। আনে আনন্দের জোয়ার।
আরও দেখুনঃ